ঠিক দুপুরবেলা বৈশাখ মাসের গরম চাঁদি যেন ফেটে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় দূরের একটা মধুর আওয়াজে নরেনের ঝিমুনিটা  কেটে গেল কোনো স্বপ্ন দেখছিল নাকি সে , না স্বপ্ন তো নয় আওয়াজটা তো ও  এখনো
শুনতে পাচ্চ্ছে , "হ্যা একদম ঠিক"  নিজের মনেই স্বগোতক্তি করলো একটু  ভেবে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল এখন পরিস্কার শুনতে পাচ্ছে একটা বাঁশি আওয়াজ বাহ খুব সুন্দর যেন খুশিতে ভরে গেল কিন্তু  হটাৎ  নরেন দেখতে পেল রুণু উর্ধসাসে কথাও ছুটে চলেছে, রেনু হলো ওর পাসের বাড়ির মেয়ে। ওর  থেকে ৩ বছরের ছোট। ওকে পাড়ার  সবাই ওকে কালী কালী বলেই ডাকে কেননা ওর গায়ের রং একটু  চাপা কিন্তু ওর মতন সুন্দরী পুরো দেশে আছে কিনা এনিয়ে নরেনের মনে কোনো সন্দেহ নেই, মনে মনে নরেন ওকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবেই দেখতে চায় কিন্তু সাহসে কুলিয়ে ওঠেনা কেননা এক তো রেনুর মতন ডানপিটে মেয়ে তারওপর ওদের পরিবার এ তল্লাটে প্রভাবশালী বলেই সকলে জানে রেনুর বাবা এক সময়  নামকরা বারিস্টার ছিলেন। যদিও নরেনের পরিবারের অনেক সুনাম আছে নরেনের ঠাকুদা আর বাবা ওদের লেখা লিখির জন্য দেশে বিদেশে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন কিন্তু নরেনের এসব কোনো গুন টুন নেই ও শুধু মনে মনে অনেক কিছু ভাবে আর কিছুই করে উঠতে পারেনা ওর এখন বয়েস ২৫ হতে চলল বাবা তো প্রায়ই চিন্তিত থাকেন ওর  ভবিস্বতের চিন্তায়। কারণ ওদের পরিবারের সুনাম অনেক থাকলেও পয়্সাকড়ির দিক থেকে ওরা বলতে গেলে ফকির। শুধু পৈত্রিক বাড়ি তা ছাড়া ওদের আর কোনো সম্বল নেই।

নরেনের মনে একটা কেমন সন্দেহ হলো, রেনু যেন ওই বাঁশি শব্দের দিকে ছুটে চলেছে। কিন্তু কেন ওর মনটা হটাৎ করে যেন বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠলো। আরো সাত পাঁচ ভেবে সেয়েও ছুটে চলল রেনুর পিছু অবশ্যই নিজেকে লুকিয়ে যাতে অর উপস্থিতি কেউ টের না পায়। কিছু দুর যাওয়ার পর ও দেখতে পেল রেনু বুড়ো বট গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা অনেক বড়ো এবং গাছটার নীচে একটু অন্ধকার আচ্ছন্ন কিন্তু ওর মনে হলো গাছের গোড়ার দিকে আরো কেউ আছে। রেনু ওখানে মন্ত্রমুঘ্ধের মত দাঁড়িয়ে আছে। নরেন আরেকটু এগিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো কে আছে।

ইতিমধ্যে তন্ময়ের বাঁশী বাজানো থেমে গেল ওর মনে হলো কে যেন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবার আগেই মিষ্টি গন্ধেই ও বুঝে গেল কে এসেছে কিছু বলার আগেই রেনু তন্ময়ের চোখ ঢেকে ধরল, রেনু আমার এই সব একদম ভালো লাগেনা কিন্তু, রেনু খিল খিল করে বলে উঠলো কেন কেন আমি তো আগেও তোমার চোখ এমন করে ঢেকে ধরেছি তখন তো তোমার ভালই লাগত ,না আমার এসব সিনেমার মতন এমন হাভ ভাব একদম পছন্দ ছিলনা কোনো কালেই, মুখটা বেশ রাগী রাগী করে বললো  তন্ময়। ব্যস এই না যেই বলা মনে হলো যেন রেনুর বড় বড় চোখ দুটি ভেজা স্ফটিক বলের মতন  টলমল করে উঠলো। তন্ময় বুঝতে পারল এবার আর ও সামলাতে পারবেনা, ভেবেই হা হা করে হেসে উঠলো রেনু  অবাক হয়ে শুধু বড়ো বড়ো তাকিয়ে দেখতে থাকলো আর অমনি ওর চোখ থেকে দু টুকরো হীরের মতন জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে লাগলো আর তন্ময় হাসি থামিয়ে ওর সেই দু ফোঁটা জল মাটিতে পড়ার  আগেই হাতের তালুতে ধরে ফেললো। " এই যে তোমার দু ফোঁটা  জল এটা আমার অভিনয়ের পুরস্কার এটা জল নয় এটা দুটো  হীরের টুকরো " তন্ময় বেশ কায়দা করে বললো কথাটা। ও তার মানে তুমি আমাকে কাঁদাতে  পারলেই বুঝি খুব খুশি হও রেনু এক দৃষ্টে তন্ময়কে দেখতে দেখতে বললো। না না মানে ইয়ে ব্যপারটাকে এভাবে নিয়োনা আসলে তুমি কাঁদলে খুউব সুন্দর দেখায়। তাই লোভ সামলাতে পারিনি সরি সরি এই কান ধরছি নাকে খত  দিচ্ছি আর কখনো এমন করবো না লক্ষ্মীটি। এবার রেনু কাঁদতে কাঁদতে হেসে দিলো  ও এইযে কথাটা বললে সেটা বুঝি সিনেমা সিনেমা মনে হচ্ছেনা।  হ্যা তাইতো আমিও তো সিনেমার মতন ডায়লগ বলছি। হটাৎ রেনুকে জড়িয়ে ধরলো এই আকস্মিকতায় রেনু কেঁপে উঠলো ওউ চাইছিল তমুদা ওকে জড়িয়ে ধরুক কিন্তু কোনো এক অজানা ভয়ে ও তমুকে ঠেলে দিতে চাইল কিন্তু পারলো  না শুধু হিসহিস করে বলল তমুদা ছেড়ে দাও কেউ দেখে ফেলবে। তমু আরও শক্ত করে ধরল। ওদের নিঃশ্বাস মিষে যাচ্ছে ধীরে ধীরে পৃথিবীটা যেন শান্ত হয়ে গেছে চোখের পলক সে তো পড়ছে না। তমুর ঠোট রেনুকে ছুটে চাইল। রেনুর মনে হতে লাগলো তার যেন কিছুই করার মতন শক্তি নেই। নাহ আর সামলাতে পারলনা রেনু মিশে গেল তমুর মধ্যে। একি হলো রেনুর মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত সেই এখন। আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই তার। এই বিহঃবলতায় মধ্ধেই ওর যেন সম্বিত ফিরে আসলো। রেনু বলে উঠলো তমুদা কি হচ্ছে এটা ,ছারো -  ছারো বলছি নইলে আমি বাবাকে সব বলে দেবো।

এদিকে নরেন গাছের আড়াল থেকে সব দেখছে আর নিজেকে অসহায় মনে করছে। ওদের কথা বার্তা কিছুই শুনতে পারছে না সে  শুধু দেখতে পাচ্ছে , রেনু ওর  ভালবাসা আর সে কিনা অন্য এক জনের সাথে দেখা করতে এসেছে। ছিঃ নিজেকে ধীক্কার দিল নরেন আমার দ্বারা কিসসু হবেনা এত দিন ধরে ভালোবাসি, আর কিনা বলতে পারছিনা , ওর সম্পূর্ণ রাগ গিয়ে পড়ল তন্ময়ের উপর মনে হচ্ছে ওর নাক টা এক ঘুসি তে ভেঙ্গে দেবে কিন্তু কিছুই করতে পারল না। নিজেকে আবার অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিল তার ,এভাবে কাউকে পিছু করা উচিত নয়। এই টানাপোড়েনের মধ্যেও কিন্তু ও নিজেকে কিছুতেই রেনুকে লক্ষ্য করা থেকে বিরত রাখতে পারছিলনা ,নরেন দাড়িয়ে রইলো পরবর্তী ঘটনা দেখার জণ্যে।

রেনু কোনমতে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে তন্ময়ের বাহুবন্ধনী থেকে 

কি বলবে বাবাকে আমি তমুদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম বুড়ো বট গাছের তলে আর তমুদা আমাকে জাপটে ধরেছে, বাবা তোমাকে আস্ত রাখবেন ভেবেছ ?

আমার বাবা ওরকম নয় বুঝলে আমাকে উনি কখনো বকাবকি করেননি তো মারধোর তো দুরের কথা। বাবাকে দেখতেই রাগী রাগী উনি খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ।

ও  আচ্ছা এই ব্যাপার  তাহলে তো বাবার কাছে ভালো মেয়েটি হয়ে থাকলেই তো পর আমার কাছে ছুটে আস কেন 

আসি কি আর সাধে তোমার এই বাঁশির সুর শুনলে আমি আর স্থির থাকতে পারিনা যেন হামেলিনের বাঁশিওয়ালা, আচ্ছা তমুদা তুমি এই সুর কথা থেকে পাও গো।

কিজানি আমি যখন বাঁশি বাজাতে শুরু করি তখন কোথা থেকে যেন সুর বাঁধ  ভাঙ্গা নদীর মতন আসতে থাকে। বলেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তন্ময়।

রেনু জিগ্গেস করলো কি হলো আবার তোমার। 

তন্ময় আরও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল কি হবে এই সুর দিয়ে কেউ তো এই সুর পছন্দই করেনা 

কে বলল পছন্দ করেনা এই যে আমি যে ছুটে ছুটে আসি তোমার সুরের পিপাসায়।

তন্ময় এবার একটু স্মিত হেসে রেনুর গালটা আলতো করে টিপে দিল আর বলল খুকি তুমি তো আমার এক নম্বর ভক্ত আছই, কিন্তু আমি বড়ই স্বার্থপর একটা ভক্তে মন ভরছে না যে আমার। আসলে কি যেন আমি একজন পেশাদার সুরকার হিসেবে নিজেকে দেখতে চাই। আমার কপাল যেমন কোনো ফিল্ম    ডিরেক্টর আমার করা সুর শুনতেও   চায়না।  

তন্ময়ের কথা শেষ হবার আগেই রেনু বলে ওঠে শুনবে গো শুনবে এত নিরাশ হোয়ো না, আমার বাবার এক জন সুরকার বন্ধু আছে উনি একজন আসিস্টান্ট খুজছিলেন আমাদের বাড়িতে এক মাস আগে এসেছিলেন তখন বলেছিলেন। বাবাকে আজ ই বলব অনার সঙ্গে তোমার জন্যে কথা বলতে কোনো ভাবে ওনাকে তোমার সুর শোনানো যায় কিনা।

ওরে  বাবা তোমার বাবা ওনার  সামনে গেলে আমার গলা শুকিয়ে যায়, মুখ এমনি থেকে বন্ধ হয়ে যায় যেন তালা মারা  সিন্ধুক আর আর আর হার্ট বিট ও বেড়ে যায়।

ইস কি বীরপুরুষ আমার কপট  হাসি হেসে বলল রেনু আরে বাবা এটা তো তোমার ভালোর জন্যেই, আর তোমার যদি ভালো হয় সেটা তো আমাদের ভবিস্বতের জন্যই তো ভালো, তুমি যদি বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারতে তাহলে খুব ভালো হত, যাই হোক তুমি যখন কথা বলতে চাইছ না আমি ই নাহয় কথা বলব। তোমার ওই বিসন্ন মুখ আমি দেখতে পারব না।

এটাতে যেন তমুর পুরুষত্তে ঘা পড়ল। ও উত্তেজিত হয়ে বলল - কি বললে তুমি চেষ্টা করবে আর আমি সেটার ফল খাব, তার মানে তুমি আমাকে ভরসা করতে পারছ না তো , ঠিক আছে আমিও তোমাকে দেখিয়ে দেব কিভাবে সফল হতে হয় আর কেমন বীরপুরুষ আমি। তোমার বাবার সঙ্গে আমি যাব দেখা করতে, তন্ময়ের মনের ভিতর সুবিমল গুপ্তর  মুখটা  ভেসে উঠলো আর ওর বুকটা ভারী হয়ে উঠলো অজানা আশঙ্খায় সেটা রেনু অবশ্য তমুর মুখ দেখে বুঝতে পারলনা।

ইতিমধ্যে রেনু শুনতে পেল কেউ ওকে ডাকছে বলে। এইরে টেপির মা এদিকেই আসছে রেনু ঘুরে দাড়িয়ে তাড়াতাড়ি তন্ময় কে আড়াল করে দাড়ালো। টেপির মা হলো ওদের বাড়ির ৫ জন কাজের লোকের মধ্যে একজন। বাবা ৫ বছর আগে ওকে আশ্রয় দিয়ে ছিল বাড়িতে, যখন ও অবিবাহিত অবস্থায় গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল আর গ্রাম সুদ্ধ লোক ওকে নষ্টা মেয়ে বলে মেরে ফেলতে চেয়ে ছিল। বাবার মধস্ততায় ব্যাপারটা খারাপের দিকে এগোয়নি। টেপির মা রেনুর থেকে মাত্র ২ বছরের বড় কিন্তু কথা বলার ব্যাপারে যেন ৮০ বছরের বুড়ি।  ওর  মেয়ের নাম টেপি তাই জন্যে রেনু ও বাড়ির সকলে ওকে টেপির মা বলেই ডাকে। ওর  অবশ্য একটা ভালো নাম আছে যমুনা - যে নামে ওকে কেউ ডাকে না।

টেপির মা এদিকে আসার আগেই রেনু ইশারায় তাড়াতাড়ি  তন্ময়কে বট গাছের লাগোয়া কাঁচা মন্দিরে লুকিয়ে পড়তে বলল। তন্ময় কিছুতেই লুকিয়ে পড়তে রাজি ছিলনা কিন্তু সে রেনুর আনত চোখের মিনতি ফেরাতে পারল না। এবং মন্দিরে লুকিয়ে পড়ল। 

ইতি মধ্যে টেঁপির মা আরও কাছে এসে পড়েছে ...।
কি গো রেনু দিদি সকলে তোমায় খুঁজে খুঁজে সারা আর তুমি এখানে
রেনু একটু এগিয়ে আসলো যাতে টেঁপির মা তন্ময় কে না দেখতে পায় ...... কেন কি হয়েচ্ছে রে টেঁপির মা।
তুমি কি কিছু রান্না করছিলে
কেন? হ্যাঁ করছিলাম তো ওহো একদম ভুলেই গেছিলাম। ওভেন এ পায়েশ বসিয়ে ছিলাম কিন্তু বন্ধ করতে ভুলে গেছি, পুড়ে গেছে নাকি রে ?
হ্যাঁ গো দিদি তুমি যে কি কর না কিছছুটি তোমার খেয়াল থাকেনা, সারা বাড়ি পোড়া পায়েশের গন্ধে ভরে গেছে

হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি , টেঁপির মা আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ওর কথাটা প্রায় থামিয়ে দিয়ে বল্লল রেনু।

টেঁপির মা বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলে, এখনও  কত কাজ বাকি রান্না বাকী বাসন মাজাও সম্পূর্ণ হয়নি আর .... (ও আরও কিছু বলতে ছাইছিল, রেনু ওসব না শুনেই বলল তুই এখন যা এখান থেকে) শোনা গেলনা।

তন্মন্য় লুকিয়ে আছে মন্দিরে আর এই ব্যাপারটা ওর  একদমই পছন্দ হচ্ছেনা, নিজের উপরে নিজের রাগ হচ্ছে কি এমন অপরাধ করেছে ও যে এভাবে অপরাধীর মতন লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। না না আমার দ্বারা একাজ হবেনা বলেই অসন্মতিসুচক ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরোতে যাবে মন্দির থেকে তখুনি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল কেউ যেন একটা জঙ্গলের ভেতর থেকে নজর রাখছে ওদের দুজনের উপর,  আরেকটু ভালো ভাবে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো সে হ্যাঁ এবার পরিস্কার দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে পরনে একটা কালো বারমুডা আর গায়ে নীল রঙের টিশার্ট, কিন্তু একে তো তন্ময় চেনেনা।তবে এ নিশ্চয়ই সুবিমল রায়ের লোক হবে যে রেনুর উপর নজরদারি করছে।

আচমকা নরেনের চোখা চুখি হয়ে গেল তন্ময়ের সঙ্গে। দুজনের চোখেই জিজ্ঞাসা আর রাগ ফুটে উঠলো। তবে তা বেশিখ্ক্ষণ স্থায়ী হোলো না কারণ রেনু তমুদা তমুদা ডাকতে ডাকতে একদিকেই আসতে লাগলো, আর নরেন বুঝতে পারলো এখানে আর থাকাটা সমীচীন হবেনা ব্যস যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ নরেন ত্বরিত গতীতে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তন্ময় মন্দির থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল ওর সারা গায়ে মাকড়শার জাল লেগে রয়েছে জা দেখে রেনুর প্রচণ্ড হাসি পেয়ে গেল, ত্নময় রেনুর হাসি কে পাত্তা না দিয়ে, ওর হাত দুটো কনুইয়ের উপর ধরে ফেলল আর বলতে লাগল জানো আআমি এখ্খুনি একটা ছেলেকে দেখলাম আমাদের উপর নজর রাখছিল, আর আমার সঙ্গে তাকাতাকি হয়ে যেতেই জঙ্গলের ভিতর কেতে পড়ল, দেখলে তো এমনি কি আর আমি সুবিমল রায়কে ভয় পাই। 

কি কি ? ভ্রুটা এক্তু বাঁকিয়ে বলল রেনু 

মানে তোমার বাবা আমাদের উপর নজরদারি করাচ্ছেন লোক দিয়ে, তন্ময় ছোট ছোট চোখ দুটো বড় বড় করে বলল 

হতেই পারেনা বাবা আর অন্য কারও ওপর নজরদারি করাবেন ওনার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার নিশ্ছই কোনও একটা ভুল হচ্ছে , আচ্ছা কেমন দেখতে গো ছেলেটা -

উমম উজ্জল শ্যামবর্ণ মুখটা ডিম্বাকার চুলগুলো ছোট করে কাটা স্বাস্থ্যবান চেহারা। আমাকে দেখেই ভয়ে পালিয়ে গেল। 

এতা সোনার পরই রেনুর মুখটা হাল্কা হাসিতে ভরে গেল ও ও বুঝতে পেরেছি তুমি কাকে দেখেছ

কাকে ? আবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল তন্ময়।

তুমি যেমন বর্ণনা দিলে তাতে তো মনে হচ্ছে এক নিশ্চয়ই নারু দা। তোমার নারু দাকে মনে নেই তোমার থেকে এক বছরের জুনিয়র। কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সুকান্তর কবিতা আবৃতি করে খুব প্রসংশা পেয়ে ছিল 

হ্যাঁ হ্যাঁ এরকম কবিতা বলে অনেকেই প্রসংশা পেতে পারে এমনকি আমিও ওর থেকে অনেক ভালো কবিতা আবৃতি করতে পারি।

রেনু আরও এক পশলা হেশে নিল, নারুদার মাথায় অল্প ছিট আছে কখন যে কি করে তা নিজেই জানে না

তন্ময়ের রেনুর কথা বিশ্বাস হোল না ওর মাথায় যদি ছিটই থাকে তবে ও তোমাকে ফলো করছিল কেন?

এবার রেনু প্রায় অট্টহাস্য করে উঠল, ভালবাসলেই বা  কি ? কেন তোমার কি হিংসে হচ্ছে।

হিংসে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়।

ও ঢং  বলে উঠলো রেনু, আমি কি ওকে ভালোবাসি  নাকি এতই যদি ভয় তাহলে বিয়ে করছনা কেন,

বিয়ে করা কি মুখের কথা, যে বললাম আর হয়ে গেল এর জন্যে যথেষ্ট পরিমানে প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, আর তুমি এখনো বড়ই হওনি ( রেনু বড় বড় করে দেখল তন্ময়কে ) 

যাকগে তুমি বিয়ে করতে চাওনা ঠিক আছে আমিও একদিন তোমাকে ছেড়ে চলে যাব আসবনা তোমার কাছে। 

তন্ময় রেনুর মুখটা চেপে ধরল।

এটা বলা কি খুব জরুরী ছিল। তন্ময় মুখটা দুখি দুখি করে বলল। আর কক্ষনো এমন কথা বলবে না তাহলে আমার মরা মুখ দেখতে হবে। রেনু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু মুখ দিয়ে আর কথা বের হলনা। 

অ্যাই তাহলে বাবাকে বলে রাখব তুমি আসছ ।

হ্যাঁ একদম পাক্কা, ভালো করে খাবার দাবার বানিয়ে রেখ কিন্তু।

রেনু মুখতা একটু ভেংচে চলে যাবে বলে যেই পা বাড়িয়েছে ওমনি তন্ময় ওর বাঁ হাত টা টেনে ধরল। কিছু বোঝার আগেই তন্ময় রেনুর ঠোঁটে ছবি একে দিল ওর ঠোঁট দিয়ে।

রেনুর মুখ রক্তিম হয়ে উঠল তারপর এক দৌড় লাগাল বাড়ীর দিকে।


রায় বাড়ীর সামনে জটলা। রেনু একটু থমকে দাঁড়ালো, কি ব্যাপার কোনও গণ্ডগোল হল নাকি, 

এই যে কালী এসেগেছে ............ হাসি হাসি মুখে বলল পাশের বাড়ির অপর্ণা কাকি।

এটা শোনামাত্রই রেনুর বুকের ভেতরের ধুকপুকানি টা বেড়ে গেল কারন পাশের বাড়ির লোকজন বরাবরই ওদের বিপদে খুশি হয় এদের হাসি মানেই আমাদের নিশ্চয়ই কোনও বিপদ হয়েছে। রেনুর পা যেন পাথর হয়ে গেছে এগুতে ছাইছেনা। রেনু কোনরকমে বাড়ির ভেতরে গেল। উঠোনে এত লোক মনে হচ্ছে যেন সারা গ্রাম ওদের বাড়িতে এসে পড়েছে। রেনু কারও কারও মুখের দিকে চেয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল, কিন্তু সবার মুখেই যেন একটা রাগ ফুটে উঠল। আরেকটু ভেতরে যেতেই ও দেখতে পেল ৪-৫ জন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে আর বারান্দায় পুলিশ ইন্সপেক্টর মামা ওনাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে মামার হাবভাভ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুব জটিল। ইন্সপেক্টর খালি মাথা নাড়ছে আর হাতের লাঠিটা দিয়ে নিজের হাতে আলতো আলতো করে মারছে। ইন্সপেক্টর কে দেখে মনে হচ্ছে উনি মামার এই কাকুতি মিনতি করার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছেন। রেনু বাড়ীর ভেতর ঢুকে গেল।

ঘরের ভেতরেও অনেক লোক। রেনুর দিকে সকলে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। তবে কি ওর দ্বারা কোনও ভুল কাজ হয়েগেছে ? কিন্তু আজতো সকাল বেলায়ও সবাই আনন্দে ছিল বাবা প্রতিদিনের মতই রেনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ছিলেন নিত্য পুজোর পরে এবং হাসি মুখেই ছিলেন। মা ও নিজের কাজ আর গান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। রেনুর মা খুব ভালো গাইতে পারেন কয়েকবার গানের জলসায় গেয়েওছেন, তার জন্য অবশ্য ওনাকে অনেক নিন্দে মন্দ শুনতে হয়েছিল, আজ থেকে উনিশ কুড়ি বছর আগে বাংলাদেশে মহিলাদের জলসায় গান গাওয়াতাকে সমাজ সহজ ভাবে মেনে নিতে পারতনা। সেই সময় রায় পরিবার , মানে সুবিমল রায়ের বাবা পরিমল রায়ই নিবেদিতার (রেনুর মা) সমর্থনে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন ছেলেরা যদি গাইতে পারে তবে মেয়েরাই বা গাইতে পারবেনা কেন ? তারপর ওনার নিবেদিতাকে নিজের ছেলের বৌ হিসাবে পছন্দ হতে বেশি দেরি হয়নি। প্রথাগতভাবে সম্মন্ধ করে বিয়ে হলেও সুবিমল আর নিবেদিতার মধ্যে হে আত্মার টান আছে সেটা আশপাশের লোকজন ভালই উপলব্ধি করতে পারে। এই ভালবাসাও অনেকের চোখে কাঁটার মতো বেঁধে শুধু কিছু বলতে পারে রায় পরিবারের পতিপত্তির কথা ভেবে।
রেনুকে বড় ঘরে ঢুকতে দেখেই মামি এগিয়ে আসলো, রেনু মামিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মামি বলে উঠল। তোর বাবার নামে বার অ্যাসোসিয়েসনের পক্ষ থেকে তহবিলের টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগ এনেছে, তাই পুলিশ এসেছে তোর বাবাকে অ্যারেস্ট করতে। রেনু এটা শুনে কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা। এসমন্ধে কোনও ধারনা নেই, আইন কানুন পুলিশ কাছারি এসব ব্যাপার ওর কাছে ভিন গ্রহী।


মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা যেন, এই কিছুক্ষন আগেও যে মুখে গান আর হাসি লেগেছিল সেখানে এখন বিরাজ করছে মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা, মা কোনও কথা বলছেনা মালতি মাশির কাঁধে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। এসবের মাঝে রেনু খেয়াল করেনি ওর নিজের চোখ দিয়ে কখন জল গড়িয়ে যাচ্ছে।

পাড়ার অনেকে মাকে ঘিরে বসে রয়েছে সবই মহিলারা এদের কোনও দিনই ওদের বাড়িতে আসতে  দেখেনি রেনু। আজ যেন ওরা রায় বাড়িতে ঢোকার অলিখিত অনুমতিপত্র পেয়েগেছে। কেউ সহানুভুতি দেখানর নাম করে এসেছে ঘরের এটা ওটা নেড়ে চেড়ে দেখছে দেখে মনে হছে হয়তোবা জিনিসগুলো নেবার ইচ্ছেও রয়েছে, কেউ বা পানের বাটা থেকে পান সাঁজছে, কেউ বা নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত। মোটকথা রায় বাড়ির সমন্ধে যে গল্প প্রচলিত রয়েছে তা স্বচক্ষে দেখার সুবর্ণ সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। এদের মধ্যে দুই এক জনই হয়তো পাওয়া যাবে যারা সত্যিই পাশে দাঁড়াতে এসেছে এই দুর্দিনে।

রেনুর বাবা বিখ্যাত উকিল রঞ্জন মিত্র খুলনা কোর্ট এ প্রাক্টিস করেন ওনার সততা নিয়ে কেউ কোনও দিন প্রশ্ন তলার সাহস পায়নি, আর পাবেই বা কি করে দেশবন্দু চিত্তরঞ্জন দাশের পরে এই বাংলায় আর এত ভালো উকিল ও মানুষ জন্মায় নি সেই রঞ্জন মিত্র আজ অপরাধী বোসপাড়ায় কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিলনা এমন একটা লোক পাওয়া যাবেনা  যে ওনার দ্বারা উপকৃত হয়নি। অন্যায়ের প্রতিবাদে রঞ্জন সবার আগে  



 ........... (to be continued) 








Comments